সোমবার, ১৫ আগস্ট, ২০২২

মনোদৈহিক ব্যাটাগিরি ও চা বাগানের জনজাতিসমূহের খণ্ডিত বয়ান

 


.আমরা ব্যাটাগিরি বুঝি না, আমরা বুঝি কেবলই দুঃখ-কষ্ট-অভাব-অনাহার-লাঞ্চনা-বঞ্চনা...


শরীর আর মনের উপর দিয়ে দগদগা যে নিপীড়ন চালানোর শক্তি বা ক্ষমতা- সেটাকে হয়তো আপনাদের মতন শিক্ষিতজনেরা মনোদৈহিক ব্যাটাগিরি বলে আখ্যা দেন। বেয়াদবি নেবেন না। আমাদের শিক্ষা নেই, জ্ঞান কম বা নাই বললেই চলে। তারপরেও সৃষ্টিকর্তা মাথার খুলির ভেতরে যে ছটাক পরিমাণ মগজ দিয়েছেন দয়া করে, সেই মগজ দিয়েই যৎসামান্য নিজেদের মতন বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করি। ভুল কী শুদ্ধ জানি না। তবে জানি-বুঝতে পারি, আপনাদের এই দাপুটে ব্যাটাগিরিতে তছনছ আমাদের জীবনের তাবৎ বৈচিত্র্যময়তা। আপনাদের ব্যাটাগিরি আমাদের পূর্বপুরষদের ভিটে-মাটি থেকে শেকড় ছিঁড়ে তুলে আনতে পেরেছে, বিচ্ছিন্ন করতে পেরেছে আপন আপন সমাজ-সংস্কৃতির পরিমন্ডল থেকে। অনেক প্রতাপ আপনাদের ব্যাটাগিরির।ক্ষমতা’, ‘লোভ’, আরমুনাফা চক্করে বিভাজিত এই ধরিনীর একপাশে আপনারা তাবৎ ক্ষমতারধররা, আরেক পাশে আমরাআপাত ক্ষমতাহীনরা। আপাত বলছি এই কারণে যে, আমাদের মনোজগতে ক্ষমতাহীন বলে পৃথিবীতে কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। আমাদের চারপাশের লতা, পশু, পাখি, মাছ, পিঁপড়া, সাগর, নদী, পাহাড়, আগুন, বাতাস-সকল কিছুরই কোন না কোন শক্তি/ক্ষমতা রয়েছে। এই যে, আমরা চা বাগানেরকুলি’ ‘শ্রমিকবাবাগান দাসরা এতোগুলা বছর ধরে আপনাদের তুচ্ছতাচ্ছিল্য-নির্যাতন-নিপীড়ন সয়ে চলেছি পরদাদা-দাদা-বাবা-আমরা এক অবিচ্ছিন্ন পরম্পরায়- সেটার জন্যও আমাদের একরকমক্ষমতাধরহতে হয়- দুঃখকে সওয়ার, নির্যাতন-নিপীড়নকে সওয়ার। আমরা সেই অর্থেক্ষমতাবান আপনাদের ব্যাটাগিরিতে এই আমরা যারা কোণঠাসা, তাদেরকে অর্থ্যাৎ আমাদেরকে ক্ষমতাহীন ভাবতে, দূর্বল ভাবতে আপনারা স্বস্তি পান(!), আরাম বোধ করেন(!), আপনাদেরই পুস্তকি ভাষায় সেটা নিতান্ত পৈশাচিক হলেও। এই যে আপনাদের নিজেকে ক্ষমতাশালী মনে করার মনস্তত্ত্ব-এই মনস্তত্ত্বের আলোকেই আপনারা বিচার করেন আপনাদের চারপাশকে, চারপাশের জনজীবনকে। অপরের বৈচিত্র্য-সৌন্দর্য, জীবনের রূপ-রস, আপনাদের মুগ্ধ করে না, কেননা সেটা আপনাদের আরোপিত সৌন্দর্য্যরে মাপকাঠি উৎরাতে পারে না। বিশ্বাস করেন, এটা আমাদেরই ব্যর্থতা, আমাদেরই অক্ষমতা। আমরা পারিনি আপনাদের মতন করে জীবনকে চিনতে, আমাদের জাতিগত চরিত্রের কারণেই আমরা আপনাদের মতন করে নিজেদের চেনাতে পারি না। আমাদের এই ব্যর্থতাই আমাদের স্বাতন্ত্র্যতা। ব্যাটাগিরি আপনাদের এতোটাই সভ্য(!) করে তোলে, এতোটাই জ্ঞানী(!) করে তোলে- যে তথাকথিকজ্ঞানগরিমাআরসভ্যতারদোহাই দিয়ে অপরকে সহজেইঅসভ্য’(?), ‘মূর্খরূপে হাজির করান আপনাদের মনোজগতের আয়নায়। এই যে আপনাদের বর্তমান মনোদৈহিক ব্যাটাগিরি এটা আসলে নতুন কোন প্রপঞ্চ নয়, বলা চলে বেশ পুরাতনই- সেই পরম্পরাগত দৃষ্টিভঙ্গিকেই আপনারা আপনাদের উত্তরাধুনিক বা নয়া উত্তরাধুনিক জমানায় ধারণ করে চলেছেন-লালন করে চলেছেন; কেননা এতে আপনাদের সুবিধে অনেক।


. ‘চা-শ্রমিক’, ‘চা বাগানের কুলিসহ নানান অভিধায় হারিয়ে যায় আমাদের আপন আপন জাতিগত ঠিঁকুজি

একটি কুড়ি দুটি পাতা রতনপুর বাগিচায়

অমল কোমল হাত বাড়িয়ে লছমি আজো তোলে

সবুজ পাতার বাহারে দুলতো দোদুল আহারে

প্রেমের পরাগ তার ছডাতো হাসিলে

বাতাসে নাচিলে...

 

[ ভূপেন হাজারিকার একটি গানের কথা ]

 

দুটি কুঁড়ি একটি পাতাআমাদের এই বন্দীশালার বাইরের জগতের মানুষদের মনে দোলা দিলেও এই কুঁড়ি-পাতা সংগ্রহে নিয়োজিত  আমাদের কাছে ব্যাপারটা মোটেও সেরকম নয়। চা বাগানে শ্রমিক হিসেবে কাজ করি আমরা প্রায় ১১৬ টি জনজাতির অধিভূক্ত মানুষজনেরা। ভাষাতাত্ত্বিক দিক থেকে আমরা কোল (মুন্ডা,সাঁওতাল, হো, খাড়িয়া), দ্রাবিদিয়ান (ওঁরাও, কন্দ, গোন্ড, মালপাহাড়িয়া), আর্য (বাংলা, হিন্দি, ওড়িয়া) ভাষা পরিবারের অন্তর্গত। যদিও আপনাদের কাছে আমরা শুধু চা বাগানেরকুলি’, ‘শ্রমিকহিসেবেই পরিচিত।  ১৫৮৯ সালে ডাচ পরিব্রাজক লিনচোটেন তাঁর লেখায় জানান, ভারতীয়রা এক ধরণের গাছের পাতা রসুনের সাথে মিশিয়ে সবজি হিসেবে খান; আবার কখনো কখনো এই পাতাকে সিদ্ধ করে পানীয় পান করেন বৃটিশ ভারতের আসামে ১৮২৩ সালে স্কটিশ পরিব্রাজক রবার্ট ব্রুস আসামে বন্য চা গাছের সন্ধান(!) পান। তিনি অরুনাচল প্রদেশে বসবাসরত আমাদের মতই প্রকৃতি ঘনিষ্ট সিঙফু আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর  লোকজন তাদের প্রধানের সাথে সাক্ষাত করলেন-যারা এই বন্য গুল্ম জাতীয় গাছের পাতা থেকে পানীয় পান করতেন, ঔষধী হিসেবে ব্যবহার করতেন। ভারতবর্ষের বিভিন্ন আদিবাসী জনজাতির লোকজন এই গাছ দিয়ে বিভিন্ন রোগবালাইয়ের চিকিৎসা করতেন আমাদের ধারণাতীত কাল আগে থেকেই। সেই ইতিহাস আপনাদের ছাপানো পুস্তকে জায়গা পায়নি তেমন গুরুত্ব নিয়ে। যাই হোক, গাছটি সনাক্তকরণের আগেই রবার্ট ব্রুস মারা যান। রবার্ট ব্রুসের ভাই চালর্স পরবর্তীতে এই গাছের কিছু পাতা কলকাতা বোটনিক্যাল গার্ডেনে পাঠিয়ে দেন আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য। সেখানে পরীক্ষা করে জানা যায়- এর জাত চীনের জাতের থেকে পৃথক। ১৮৩৪ এর শুরু দিকে এই চা গাছের চাষাবাদের পরিকল্পনা করা হয় এবং ১৮৩৫ সালে পরীক্ষামুলকভাবে লক্ষীপুর জেলায় চাষ করা হয়। আসামে চা শিল্পের ভিত্তি গড়ে ওঠে মূলতঃ ১৮৩৪-১৮৫০ সালের মধ্যে। প্রথম চা বাগান গড়ে উঠেছিল শিবসাগর জেলার জয়পুরে; যেখান থেকে ১৮৩৭ সালে প্রথমবারের মতো ১২ বাক্স চা লন্ডনে পাঠানো হযেছিল, পরের বছর ২৫ বাক্স। গুণগত দিক থেকে এই চা চীনের চায়ের মতোই ছিল। আর এই সফলতার হাত ধরেই আসাম টি কোম্পানী নামে বিশ্বের প্রথম টি কোম্পানী গঠিত হয় ১৮৩৯ সালে বরাক আর ব্রহ্মপুত্র আববাহিকায় শুরু হয় চায়ের বাণিজ্যিক উৎপাদন। এরপর আসামের বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে চা বাগানের জন্য জমির বন্দোবস্ত নেওয়া হয়। বাংলাদেশের সিলেটে চা বাগানের পত্তন হয় ইংরেজ বনিকদের হাত ধরেই ১৮৫৪ সালে। আপনাদের গবেষণায় জানা যায়, ১৮৭২ সালের মধ্যেই আসাম ভ্যালিতে চা বাগানের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০ টি; এর মধ্যে কাছাড় আর সিলেট অঞ্চলে চা বাগানের সংখ্যা যথাক্রমে ৮০ টি ১৩ টি

গাছ হিলায়েগা তো পাইসা মিলেগা

এই যে, একের পর এক চা বাগানের সংখ্যা বাড়তে থাকার ফলে প্রয়োজন পড়তে লাগলো হাজার হাজার চা শ্রমিকদের। শুরুর দিকে আসাম চা সংস্থা স্থানীয় কাছাড়ি বা অসমীয়দের চা বাগানে নিয়োগ করলেও পরবর্তীতেআড়কাঠিআরসর্দারনিয়োগ করা হলো চা বাগানের শ্রমিক যোগানে। ১৮৪১ সালে শ্রমিক সংগ্রহের কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতেফ্রি কন্ট্রাক্টরসসিস্টেম চালু করে ইংরেজরা। বাগান মালিকদের সাথে কমিশনের ভিত্তিতে স্থানীয় এজেন্টদের চুক্তি হতো চা বাগানের কুলি সংগ্রহের জন্য। স্থানীয় এজেন্টরা ছিল ধূর্ত প্রকৃতির, এরাই আড়কাঠি নামে পরিচিত। আড়কাঠিদের সহযোগী হিসেবে কাজ করত সর্দাররা। এই আড়কাঠি আর সর্দারদের নানান মিথ্যে প্রলোভনে পরে বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ, ছোট নাগপুর এমনকি নেপাল থেকে আমাদের মানে হাজার হাজার সাঁওতাল, ওরাও, মুন্ডা, মাহাতো, ভূমিজ শিং, গঞ্জু শিং, মালপাহাড়িয়া, গোন্দ, হাজং, মান্দি, কোচ, কেউট, তেলি, পাল, নাইডু, কুর্মি, তুর্মি, নুনিয়া, পাইনকা, ছত্রী, মাল, তংলা, ভুঁই, শবর, ভীম, বুনারজী, দোসাদ, গাড়েড়ি, থাপাল, রাজবংশী, তুলিয়া, পাত্র, তেলি, তেলেঙ্গা, বাড়াইক, গোর্খা প্রভৃতি জনজাতির মানুষদের। আড়কাঠি আর সর্দারদের প্রলোভনে পড়ে চা বাগান পর্যন্ত পৌঁছাতে আমাদের যাত্রা মোটেই সুখকর ছিল না। শুরুর দিকে জাহাজে করেই আমাদের চা বাগানে নিয়ে আসা হতো, যদিও পরবর্তীতে রেললাইন স্থাপন করা হয় চা বাগান পর্যন্ত আমাদের যাত্রা সময়কে কমিয়ে আনার জন্য। আড়কাঠি আর সর্দাররা জাহাজ ডিপো পর্যন্ত এনেই আমাদের তুলে দিতে বাগান মালিকদের হাতে কাগজে টিপ সহি নিয়ে। আমরা বুঝিনি এই টিপসহির মাধ্যমেই আমরা বিক্রি হয়ে গেছি বাগান মালিকদের কাছে, বাগান দাস হিসেবে। আর এই দাসত্ব এক প্রজন্মের নয়, প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের! সারা দুনিয়ার নানান দলিল দস্তাবেজে কালির হরফে দাস প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করা হলেও আমরা আজও বহন করে চলেছি দাসত্বের জীবন। যাই হোক, দীর্ঘ জাহাজ যাত্রা ছিল বিভীষিকাময় নরক যন্ত্রণার নাম। একেকটা জাহাজের ধারণ ক্ষমতা ২০০ জন থাকলেও সেখানে তোলা হতো হাজারেরও বেশি মানুষকে। জাহাজ বন্দরে ভিড়লে অর্ধেক নামতাম জীবন্মৃত হয়ে আর বাকি অর্ধেক লাশ। মহামারির অজুহাত তুলে লাশগুলো ফেলে দেয়া হতো পানিতে।

এই যে দলে দলে আমরা আসতে বাধ্য হলাম, এর পেছনে হয়তো হাজারও কারণ ছিল। ১৭৭৩ সালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আমাদের প্রায় সবাইকেই ভিটে হারা করেছিল। আমাদের ফসলী জমি-জিরাত-ভিটেমাটি-জাহের থান, আখড়া, শশ্মান সবকিছুই হারাতে হয়েছিল। আড়কাঠি, সর্দাররা আমাদের এই অসহায়ত্বকেই ভালমতন কাজে লাগিয়েছিল; ইংরেজ শাসকদের আরো নানান কলাকৌশলতো ছিলই। বাদ ছিল না ধর্ম প্রচারকেরাও। বৃটিশদের শাসনরাজ পাকাপোক্ত করতে ভারতবর্ষে খ্রিষ্টান মিশনারীরাও কম পরিশ্রম করেননি; আমাদের চা বাগানে শ্রমদাস বানানোতে তাদের অবদানও কম ছিল না। পূর্ব ভারতের ক্যাথলিক মিশন সোসাইটি এই কাজে প্রকাশ্যে মাঠে নেমেছিল। নিজ নিজ জাতির বিধি-বিধানে স্বাধীন আমরাশ্রমিক’, ‘কুলিনামের মোড়কে আমরা আসলে চা বাগানে শ্রমদাসে পরিণত হলাম। শুধুমাত্র ১৮৭০ থেকে ১৯০০ সালের মধ্যে এই ত্রিশ বছরে আমাদের প্রায় ,৫০,০০০ জনকে চা বাগানের শ্রমদাসে পরিণত করা হয়


. আমাদের রক্ত-ঘাম- চোখের জল বাষ্প হয়ে উড়ে বাজারি দুনিয়ার চায়ের কাপে...

 

অবস্থাদৃষ্টে আমরা আপনাদের কাছে কোন মানুষই নই। আমরা চা বাগানের কুলি, চা শ্রমিক, আমরা বাগানদাস। আমাদের কোন পাকস্থলী নাই, আমাদের খেতে হয় না। কেননা খেতে হলে কিছু চাল-ডাল কিনতে হয়, রান্না করতে হয়। কিন্তু ভাবুনতো খাবার কেনার সামর্থ্য আমাদের আছে কি না! খুব বেশি পেছনে যাওয়ার দরকার নাই। ১৯৭৮ সালে এই বাংলাদেশের চা বাগানগুলোতে আমাদের মতো বাগানদাসদের দৈনিক মজুরি ছিল মাত্র টাকা, সাথে কেতাবি (!)আবাসন আর চিকিৎসা(!) সুবিধা। কেতাবি বলছি এই কারণে যে, /১৪ ফুট ঘরে পুরো পরিবার নিয়ে আমাদের থাকতে হয়, তা  পরিবারের সদস্য সংখ্যা // যাই হোক না কেন। আপনাদের অহমে আঘাত না করেই জানাচ্ছি যে, বর্তমানে দেশের ১৬৭ টি চা বাগানে একজন করে এমবিবিএস ডাক্তার আছেন কেবল টি চা বাগানে ২০০৯ সালে গঠিত দ্বিতীয় নি¤œতম মজুরি বোর্ডে আমাদের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৪৮.৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়;আগে যেটা ছিল ৩২.৫০ টাকা। সরকারী মধ্যস্থতা এবং বিসিএসইউ বিটিএ মধ্যে আলোচনায় নগদ মজুরি বাড়িয়ে ২০১৩ সালের জুন থেকে করা হয় ৬৯ টাকা। ২০১৫ সালের জুন থেকে শ্রেণির বাগানের জন্য ৮৫ টাকা, বি শ্রেণির জন্য ৮৩ টাকা এবং সি শ্রেণির জন্য দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করা হয় ৮২ টাকা; ২০১৮ সালের চুক্তি যা যথাক্রমে ১০২ টাকা, ১০০ টাকা ৯৯ টাকায় উন্নীত হয় সর্বশেষ ১৫.১০.২০২০ সালে বাংলাদেশীয় চা সংসদ চা শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে যে গঙট স্বাক্ষরিত হয়েছে সেখানে এই মজুরির হার ১২০ টাকা, ১১৮ টাকা ১১৭ টাকা করে উল্লেখ রয়েছে। বর্তমান বাজারি দুনিয়ায় এইরকম দৈনিক মজুরির টাকায় কিভাবে পরিবার-পরিজন নিয়ে সংসার চলে? প্রশ্নটা আপনাদেরই তরেই রেখে গেলাম। উত্তর দেওয়ার ইচ্ছে-অনিচ্ছে আপনাদের মর্জি। কেননা উত্তর চাইবার মতন ধৃষ্টতা আমাদের দেখাতে নেই। আমাদের কাজ কেবল পাতা তোলা-আর আপনাদের দাসত্ব করা। বিশ্বায়নের এই যুগে শুনি সব কিছুই নাকি উন্মুক্ত! জ্ঞান-বিজ্ঞান সব-সবকিছুই। কিন্তু বিশ্বাস করেন, আমাদের মতন চা বাগানের দাসদের কাছে কাটা তারের বেষ্টনী দেয়া বাগানের ভেতর থেকে যতটুক আকাশ দেখা যায়, চা বাগানে যে লতা,ফুল কিংবা পাখি দেখি-সৃষ্টিকর্তা সুন্দর এই পৃথিবীর সৌন্দর্য্য উপভোগের সুযোগ আমাদের জন্য ঠিক ততটুকুই রেখেছেন। আমাদের রক্ত যখন ঘাম হয়ে ঝরে, সেই ঘাম চা গাছের গোড়ায় পড়লেই জানবেন চা গাছে নতুন নতুন পাতা গজায় ! আমাদের রক্ত-ঘামের স্পর্শে গজানো পাতা আপনাদের মতন মুক্ত মানুষদের চায়ের কাপে ধোঁয়া উড়ায়-আপনাদের ক্লান্তিনাশ করে শরীর মনে উদ্দীপনা যোগায়! আমাদের ক্লান্তি থাকতে নাই, কেননা আমরা যে দাস! আমরা বাগান দাস ! 

 

আমাদের শ্রমে-ঘামে উৎপাদিত চা হচ্ছে পানির পর পৃথিবীর দ্বিতীয় জনপ্রিয় পানীয়; সারা বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় বিলিয়ন কাপ চা পান করা হয়ে থাকে।  ২০১৭ সারা বিশ্বে .৯৮ মিলিয়ন টন চা উৎপাদিত হয়েছে সারা দুনিয়ায়; যার মূলে ছিলাম ১৩ মিলিয়ন বাগান দাসেরা আমাদের বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ১৬৭ টি চা বাগানের প্রায় ৬৫ হাজার হেক্টর জমিতে ৯৬.০৭ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদন করা হয়েছে। এর মধ্যে দেশীয় বাজারে বিপণন হয়েছে ৯৫.২০ মিলিয়ন কেজি আর রপ্তানী করা হয়েছে .৬০ মিলিয়ন কেজি। আর এখানে আমারা বাগান দাসেরা আছি প্রায় লক্ষ।

 

. আধিপত্যবাদ আমাদের হারিয়ে যাওয়া আপন আপন জাতিগত সংস্কৃতি

 

আমাদের মুন্ডা লোকগাথায় সৃষ্টির শুরুতেওতে দিশমবা এই পৃথিবী ছিল জলমগ্ন। সূর্য দেবতা সিংবোঙ্গা জল থেকে প্রথম সৃষ্টি করলেন কাছুয়া বা কচ্ছপ, কারকোম বা কাঁকড়া এবং লেনডাড বা জোঁক। এদের দিয়ে সমুদ্রের তলদেশ থেকে মাটি আনিয়ে তিনি তৈরি করলেন ওতে দিশম বা এই পৃথিবী। এরপর রাজহংসের ডিম থেকে একটি বালক আর একটি বালিকার জন্ম হলো। এরাই হলো হোরো-হকো বা পৃথিবীর আদি মানব-মানবী, আমাদের মুন্ডাদের পূর্বপুরুষ

 

আমাদের মুন্ডাদের আরেকটি লোকগাঁথায় পাওয়া যায়- আমাদের আদি দেবতা সিংবোঙ্গা ওতে বোরাম একটি ছেলে একটি মেয়ে সৃষ্টি করে তাদেরকে একটি গুহার মধ্যে রেখে দিলেন। আর এদের থেকেই পৃথিবীর সমস্ত মানব জাতির সৃষ্টি হলো। পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী বারোটি পুত্র বারোটি কন্যা সন্তানের জন্ম দিলেন। দেবতার নির্দেশে এরাই দম্পতি হিসেবে সারা ওতে দিশম বা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু তার আগে দেবতারা তার আগে তাদের সামনে বিভিন্ন খাদ্যসামগ্রী রেখে যার যা খুশি বেছে নিতে বললেন। প্রথম দম্পতি বেছে নিল মাংস। প্রথম দম্পতির থেকে জন্ম হলো হো জাতির। দ্বিতীয় দম্পতি বেছে নিল অন্য আরেক পশুর মাংস, তাদের থেকে তৈরি হলো ভূমিজ জাতির। তৃতীয় দম্পতি শুধু শাকসবজি বেছে নেওয়ায় তাদের থেকে সৃষ্টি হলো ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়। আরেক দম্পতি ছাগল মাছ বাছায় তাদের থেকে জন্ম নিল শূদ্র। যে দম্পতি শামুক বেছে নিয়েছিল তাদের থেকে উৎপত্তি হয়েছিল ভূইয়া জাতির। যে দম্পতি শূকর বেছেছিল তাদের থেকে জন্ম নিয়েছিল সাঁওতাল জাতি। এই ভাবে ১২ জোড়া দম্পতি তাদের বংশধরদের থেকে দুনিয়ার বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর সৃষ্টি হয়েছিল

 

আমাদের সাঁওতালদের বিশ্বাস মতে, সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী বলে কিছু ছিল না; ছিল কেবল জল আর জল। একদিন চন্দ্রের কন্যা গোসল করতে এসে তাঁর শরীরের ময়লা দিয়ে দুইটি পাখি তৈরি করল। পাখি দুটির নাম দিল হাঁস হাঁসিল। তারা পানিতে ভাসতে লাগল। অনেকদিন ভেসে থাকার পর তারা একদিন ঠাকুরজিউ অর্থ্যাৎ ইশ্বরের নিকট খাবার চাইল। সৃষ্টিকর্তা তখন পৃথিবী সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। পৃথিবী সৃষ্টি করতে সৃষ্টিকর্তা প্রথমে ডেকে পাঠালেন রাঘব বোয়ালকে। বোয়াল তার দাঁতে করে গভীর সাগরের নিচ থেকে মাটি আনার চেষ্টা করল। কিন্তু জলের উপর আনতে আনতেই মাটি জলে গলে গেল। এরপর কাঁকড়াকে আদেশ করলে সেও ব্যর্থ হয়। পরে কচ্ছপও মাটি জলের উপরে আনতে পারল না। সবশেষে কেঁচো মাটি আনতে রাজি হলো, শর্ত দিল কচ্ছপকে পানির উপরে ভেসে থাকতে হবে। ঠাকুরের নির্দেশে কচ্ছপ রাজি হলে কেঁচো তার লেজ কচ্ছপের পিঠের উপরে রেখে মুখ দিয়ে মাটি খেতে শুরু করল আর লেজ দিয়ে কেঁচোর পিঠে মাটি জমা করতে লাগলো। এভাবে কেঁচোর পিঠে মাটি জমতে জমতে পানির উপরে সরের মতন মাটির একটা আস্তরণ তৈরি হল। এই আস্তরণ জমতে জমতে শক্ত হয়ে একসময় মাটির সৃষ্টি হল। মাটিকে শক্ত করার জন্য সৃষ্টিকর্তা প্রথমে ঘাস, পরে শাল, মহুয়া ইত্যাদি নানান বৃক্ষ সৃষ্টি করলেন। কিছুদিন পর মেয়ে পাখিটি দুটি ডিম দিল এবং তাতে তা দিতে শুরু করল। নয় মাস দশ দিন পর ডিম ফুটে একজন পুরুষ একজন নারী বের হয়ে এলো। এদের নাম পিলচু হাড়াম পিলচু বুড়ি আমাদের সাঁওতাল বিশ্বাস মতে, এরাই পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী আর আমরা দুনিয়ার সকল মানুষই তাদের বংশধর। একই রকম ভাবে আরো অনেক অনেক মিথ প্রচলিত রয়েছে আমাদের জনজাতি সমূহের নিজস্ব সংস্কৃতিতে। এই যে সৃষ্টিতত্ত¦গুলো বিশ্লেষণে একটা ব্যাপারই বেশ পরিষ্কার হয় আমাদের আদি মানব-মানবী মূলতঃ একই। যারা ভিন্ন ভিন্ন নামে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বিশ্বাসে জায়গা করে নিয়েছে।

 

ছোট নাগপুর, বিহার, উড়িষ্যা, রাজমহল কিংবা বাংলায় আমাদের পূর্ব পুরুষেরা একসময় নিজ নিজ জাতিগোষ্ঠীর রীতিনীতি নিয়ে বেশ সংহত অবস্থানেই ছিল। পর্যাপ্ত আবাদী জমি নাকি আমাদের অভাব বুঝতে দিতো না। জানা যায়,  ছোট নাগপুরে আমাদের ওঁরাওদের একেকটি পরিবারে কমপক্ষে ৫০/৬০ বিঘা আবাদী জমি ছিল সেই আবাদী জমিতে ঘামে ফলানো ফসলে সমৃদ্ধ ছিল আমাদের গাঁও-গেরাম। কিন্তু রায়তি,পাট্টা, কবুলিয়ত, চিরস্থায়ী বন্দোবস্থসহ ভূমির নানাবিধ মারপ্যাঁচে আমাদের পূর্বপুরুষদের জমিগুলো আর আমাদের থাকলো না। নিজেদের আবাদী জমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে আমরা আরো জলাজঙ্গলের দিকে এগোতে থাকলাম। হিংস্র পশুদের সাথে লড়াই করে নতুন নতুন আবাদী জমি যেই তৈরি করেছি, তখনই সেই জমি আপনাদের পূর্বপুরুষদের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়, প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায় বহিরাগত নানান বেনিয়া জাতির। তাছাড়া কোল বিদ্রোহ (১৮৩১), পাহাড়িয়া বিদ্রোহ (১৭৭২-১৭৭৮), চুয়াড় বা ভুমিজ বিদ্রোহ (১৭৬৮,১৭৯৫-১৮০০), মুন্ডা বিদ্রোহ (১৭৮৯,১৭৯৯,১৮০৭,১৮১২,১৮৯৯) দমনের ফলেও অনেককেই জমিজমার সাথে নিজের প্রাণটাকেও হারাতে হয়েছিল। এই ভাবে একে একে, আমরা আমাদের বাস্তু থেকে উচ্ছেদ হতে থাকি, আমাদের আপন আপন উৎপাদন ব্যবস্থা  থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকি। নড়বড়ে হতে থাকে আমাদের আপন আপন সংস্কৃতি। আমরা হয়ে পড়ি দিশাহীন। অনাহারে আমাদের কতশত পূর্বপুরুষরা যে মারা গেছে তার হিসেব আপনাদের কাছে নেই। ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে বৃটিশ রাজের যখন চা বাগনে শ্রমিকের দরকার পড়ল তখনই হাত বাড়ালো আমাদের দিকে। দুবেলা খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার তাগিদে বা তারও বেশি স্বপ্ন নিয়ে আমরা আড়কাঠিদের মিথ্যে প্রলোভনে পড়ে পাড়ি জমিয়েছিল বরাক আর ব্রহ্মপুত্র আববাহিকার চা বাগানগুলোতে। দীর্ঘপথ যাত্রায় আমাদের শতশত পুর্বপুরুষেরা মরে পড়ে থাকে জলাজঙ্গলে। একসময় পৌঁছায় চা বাগানে। চা বাগানে প্রবেশ করেই আমাদের পূর্বপুরুষেরা বুঝতে পারেন নির্মম প্রতারণা করা হয়েছে তাদের সাথে। আড়কাঠিদের যে প্রলোভন ছিল- ‘গাছ হিলেগা, রুপিয়া মিলেগাসেটা আর সত্যি হয়ে উঠে না আমাদের পূর্বপুরুদের জীবনে। মোহভঙ্গ ঘটে। আমাদের পূর্বপুরুষদের ঠাঁই হলো চাবাগানের কাটাতারের বেস্টনীতে। কিছুই করার থাকল না। কেননা ততক্ষণে আমরা চা বাগানের দাস হয়ে গেছি-বাগানদাস হয়ে গেছি। আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাদের আদিভূমি থেকে যেদিন থেকে বাস্তুচ্যুত হতে লাগল- জাহের থান, আখড়া থেকে বিতারিত হতে লাগল- সেদিন থেকে আদতে নিজ নিজ সংস্কৃতি থেকেই তারা বিচ্ছিন্ন হতে থাকল। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যারা একসময় সোহরাই, কারাম, এরঃক সিম পূজা, ইড়িগুঁদল, জানথাড়, সাকরাত, মাঘসিম, বাহা পরব, বাঁধনা পরব, দাশায়, শারহুল, ফালাকাটা পূজা, শারশিরির পূজা, খারিয়াল, ফাগুয়া, শারণা পরব, ডান্ডাকাটা, জিতিয়া পরব, গরয়া, গাঙ্গে আড়িয়ানাম, টাডে আড়িয়ানাম, গারিয়া পূজা, গড়াম, নয়াখানী পূজা, চড়ক পূজা,মাম্বেবাকায় পূজা, গ্রিম বুদা,টুসু পূজা, গামা পূজা, দিউড়ি পূজা, মাঘে পরব, তিস্তাবুড়ি প্রভৃতি উৎসব-পূজা-কৃত্যাদির মাধ্যমে নিজ নিজ জাতিগত সংস্কৃতিতে-আপন আপন বিশ্বাসকে লালন করে আসছিলেন- সেগুলো নাই হয়ে যেতে থাকল চা বাগানের বন্দী জীবনে। যে জীবনে সকাল-সন্ধ্যা-রাত দাসত্বগিরি করে কাটাতে হয় সেখানে জীবন-মনের অবগাহন চলে কিভাবে? চা বাগানে আমরা ৬০ টির অধিক জনজাতির পৃথক সাংস্কৃতিক ¦াতন্ত্র্য থাকলেও এখন আমাদের একটাই সংস্কৃতি দাড়িয়েছে- সেটা হলো বাগান দাস সংস্কৃতি। আমাদের নিজস্ব পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় মাঝি হাড়াম, জগমাঝি, জসপরাণিক, গোডেং, নায়েকে, পাড়হা প্রধান, আলাদা আলাদা সামাজিক মর্যাদা-ভূমিকা থাকলেও চা বাগানে আমাদের সকলের পরিচয় একটাই দাঁড়ায়- বাগান শ্রমিক বা বাগান দাস। আমাদের আতু মাঝি,দিশম মাঝি, পারগানা ব্যবস্থা বলে কিছু থাকল না। বাগান দাসদের যেন আলাদা কোন বিশ্বাস থাকতে নেই, আলাদা সমাজ থাকতে নেই। বাগানদাসদের প্রভু একমাত্র চা বাগানের বাবুরা আর তাদের সংশ্লিষ্ট জনেরা। বাবুদের বিচিত্র্য নির্যাতন-নিপীড়িত আর প্রতারণায় আমাদেরঠাকুর জিঁউ’,‘সিংবোঙ্গা’, ‘ওতে বোরাম’, ‘দেসাউলি’, ‘বরু বোঙ্গা’, ‘হারান বুড়িয়া বোঙ্গারানির্বাসিত হতে থাকল আমাদের প্রাত্যহিক কর্মে-আচারে।

আমাদের  পবিত্রইলি’, ‘হাড়িয়া’,‘হান্ডি’, ‘খর’, ‘মহুয়া’, ‘ইলকে অশৌচ করে দিয়েছে বাংলা মদের পাট্টা

 

পৃথিবীর প্রায় সকল জনজাতির মধ্যেই নিজস্ব পানীয় পানের রীতি প্রচলিত রয়েছে। এই পানীয়সমুহ আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। আমরা হো জাতির লোকজনেরা বিশ্বাস করি, সৃষ্টিকর্তা আমাদের আদি মানব-মানবী সৃষ্টির সাথে সাথেই তাদের শিখিয়ে দিয়েছিলেন কি করেইলিবানাতে হয়। আমরা মুন্ডারা বিশ্বাস করি সুর্যদেবের নির্দেশেই তোতো হারাম তোতো বুড়ি ভাত থেকে তৈরি করেছিল আমাদের নিজস্ব পানীয়। আমরা সাঁওতালরা বিশ্বাস করি সৃষ্টির শুরুতে আমাদের আদি পিতা-মাতা পিলচু হাড়াম, পিলচু বুড়ি হিহিড়ি-পিহিড়ি নামক স্থানে প্রথম বসতি শুরু করেছিল। কিন্তু চা বাগানে আমাদের সকল জাতির আলাদা আলাদা পানীয় নেই হতে হতে আজ তা পাট্টা নির্ভর হয়েছে। ইংরেজরা চা বাগান তৈরির পর দূরদুরান্ত থেকে চা শ্রমিকদের অর্থ্যাৎ আমাদের পূর্বপুরুষদের ধরে নিয়ে এসেছিল মূলত একটা উদ্দেশ্যে, যাতে বাগান দাসরা দূরত্ব অতিক্রম করে বাগান ছেড়ে পালাতে না পারে। শত নির্যাতন-নিপীড়ন মুখ বুঝে সয়ে যাতে বাগানের মাটি আঁকড়েই পড়ে থাকে। আর দীর্ঘ দিনের পুঞ্জিভুত ক্ষোভ যাতে আমাদের বাগান দাসদের বিদ্রোহী করে না তোলে সেজন্য চুুতরতার সাথেই বাগানের ভেতর মদের আড়ৎ বসিয়ে দেয়। ষাটের দশকে শুরুতে বিষাক্ত মদ পান করে হাজারে হাজারে শ্রমিক মারা গেলে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার বাগানের ভেতর লাইসেন্স দিয়ে মদের দোকান বসিয়ে দেয়, যা স্থানীয়ভাবে পাট্টা নামে পরিচিত; যেখানে বাংলা ৭০, বাংলা ৩০ ইত্যাদি বিভিন্ন ডাইল্যুশনে মদের হরদম বিকিকিনি চলছে।

 

পাত্তি ছক্কা আমাদের জাতিগত খাদ্যাভ্যাসের বাইরে এক যৌথ খাদ্যাভ্যাসের নাম

 

বাবু বলে কাম কাম

সাহেব বলে ধরে আন

সর্দার বলে লিবো পিঠের চাম

 হে যদুরাম ফাঁকি দিয়া চলাইলি আসাম...”

[ জনপ্রিয় লোকসঙ্গীতের অংশ বিশেষ]

 

পেটে কিছু দানা-পানি দিয়ে আমারা সাতসকালেই বাগানে ছুটি। নির্দিষ্ট সময়েই বাগানের কাজ শুরু করে দিতে হয়। কোন বাহানা খাটে না দেরিতে কাজে আসার। চা বাগানে আমাদেরবাগানদাসদের নিয়ন্ত্রণে লাইনম্যান, সর্দার, টিলা বাবু, ছোট বাবু, বড় বাবু, ম্যানেজার আরো কত কি ব্যবস্থাপনা! সকালে কাজ শুরু করার পর একটানা কাজ করে যেতে হয় দুপুর পর্যন্ত। দুপুরে খাবারের বিরতি। আমাদের সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো, গঞ্জু সিং, তুরি, মুন্ডা, মান্দি, মালপাহাড়িয়া, গোন্দ, হাজং, মান্দি, কোচ, কেউট, তেলি, পাল, নাইডু, কুর্মি, তুর্মি, নুনিয়া, পাইনকা, ছত্রী, মাল, তংলা, ভুঁই, শবর, ভীম, বুনারজী, দোসাদ, গাড়েড়ি, থাপাল, রাজবংশী, তুলিয়া, পাত্র, তেলি, তেলেঙ্গা, বাড়াইক জনজাতির মানুষদের খাদ্যভ্যাসে ব্যাপক বৈচিত্র্য থাকলে বাগানদাসী জীবনে তার রেশ ধরে রাখা যায়নি। দুপুরের খাবারে সকল জাতির মানুষেরাপাত্তি ছক্কানামে অভিন্ন খাদ্যাভ্যাস গড়ে তুলেছি- নিজেদের বেঁচে/টিকে থাকার প্রশ্নেই। চা গাছের কচি পাতা দুহাতের তালুকে ঘঁষে ঘঁষে চটকে নিয়ে তার সাথে পেয়াজ, মরিচ, রসুন, লবন, সেদ্ধ আলু, কাঠালের বিচি, মুড়ি/চালভাজা, চানাচুর, শুটকি একসাথে মিশিয়ে আমারা তৈরি করে নেই পাত্তি ছক্কা। //১০ জন মিলে দলবদ্ধ হয়ে  দিন-সপ্তাহ-মাস-বছর-যুগ পেরিয়ে এই পাত্তি ছক্কা দিয়েই আমাদের পাইনকা, ছত্রী, মাল, তংলা, ভুঁই, শবর, ভীম, বুনারজী, দোসাদ, গাড়েড়ি, থাপাল, সাঁওতাল, ওঁরাও, মাহাতো, গঞ্জু সিং, তুরি, মুন্ডা, মান্দি, মালপাহাড়িয়া, গোন্দ, হাজং, মান্দি, কোচ, কেউট, তেলি, পাল, নাইডু, গোর্খা, কুর্মি, তুর্মি, নুনিয়ারা একটা সার্বজনীন মধ্যাহ্ন ভোজের রীতি গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে নিজেদের যুথবদ্ধতার দূর্দান্ত একটা চর্চার ক্ষেত্র তৈরি করেছে। বঞ্চনা-লাঞ্চনা যেমন আমাদের নিকট সার্বজনীন, আমাদের বাগান শ্রমিকদের মাঝে পাত্তি ছক্কাও তেমনি সার্বজনীন খাদ্যাভ্যাসে পরিণত হয়েছে।  

 

. তারপরেও আমরা বেঁচে আছি, টিকে আছি , কেননা মানুষের বেঁচে থাকার লড়াইয়ের কোন শেষ নেই


 ÒYou can kill my body

You can kill my soul

For not believing in your god

And some world down below…

 

You don’t stand a chance against my  prayers

You don’t stand a chance against my love.Ó

                                        

                                      [Robbie Robertson]

 

শত নির্যাতন-নিপীড়ন সয়েও আমরা টিকে আছি, সেটা টিকে থাকা আমাদের নিশ্চিহ্ন না হবার যোগ্যতাকেই সামনে হাজির করে। আমরা আমাদের আদিভূমি হারিয়েছি, ভাষা হারিয়েছি, সংস্কৃতি হারিয়েছি, হারিয়েছি আরো অনেক অনেক কিছুই। তারপরেও আমরা টিকে আছি। যেই মাত্রাতেই হোক, আমাদের এই টিকে থাকা মনোদৈহিক ব্যাটাগিরির বিরুদ্ধে আমাদের নিরন্তর লড়াইকে সামনে নিয়ে আসে। কেননা মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই কোনদিন শেষ হয় না। ১৭৬৮ সালে ভূমিজ বিদ্রোহ করেছি, ১৭৭৮ সালে পাহাড়িয়া বিদ্রোহ, ১৭৮৯, ১৭৯৯, ১৮০৭, ১৮১২, ১৮৯৯ সালে আমরা মুন্ডারা বিদ্রোহ করেছি, ১৮৫৫ সালে আমরা সাঁওতাল হুল করেছি, ১৮২২-১৮৫৭ সালে আমরা ভীলেরা লড়েছি, ১৮৫৮ সালে ভীল বিদ্রোহ, ১৮৬০ সালে গোন্দ বিদ্রোহ, ১৮৬৮ সালে আমরা ভূঁইয়ারা জেগেছি, ১৯২০-১৯২১ সালে করেছি টানাভগত আন্দোলন। আমাদের নেতা -িত গঙ্গাচরণ দীক্ষিত -িত দেওসরণের ডাকেমুল্লুকে চলআন্দোলনে সাড়া দিয়ে আমরা ৩০ হাজার চা বাগানের শ্রমিক পাড়ি জমিয়েছিলাম চাঁদপুরের স্টিমার ঘাটে। সেদিন বৃটিশদের গোর্খা বাহিনী গুলি করে আমাদের শতশত মানুষের রক্তে নদীর জল রঞ্জিত করলেও আমরা এখনো টিকে আছি। জগন্নাথ সিং, বুদু ভগত, জোয়া  ভগত, ভাগোজি নায়েক, কাজার সিং, গেন্দ সিং, সিধু মাঝি, কানু মাঝি, বিরসা মু-, টানা ভগত, লক্ষণ নায়েক এর উত্তরসূরীরা বেঁচে থাকার লড়ায়ে নিরন্তর আপোষহীন।


সূত্র The Indian Tea Saga : A brief History. †`Lyb-https://www.vahdamteas.com/blogs/news/99260993-the-indian-tea-saga-a-brief-history | wePiYKvj-25.10.2020|

[1] N. K. Das, Making of Tea Tribes in Assam: Colonial Exploitation and Assertion of Adivasi Rights, Journal of Adivasi and Indigenous Studies (JAIS) Vol. III, No.1, February 2016: 1–16; Visited at https://www.academia.edu/25822076/Tea_Tribes_of_Assam_Colonial_Exploitation_and_Assertion_of_Adivasi_Rights on 31.10.2020.

[1] Addessing the human cost of Assam Tea :An Agenda for change to respect,protect and fulfil human rights on Assam Tea palantation, Oxfam Publication. we¯ÍvwiZ †`Lyb-https : // oxfamilibrary . openrepository . com / bitstream / handle / 10546 / 620876 /bp-human-cost-assam-tea-101019-en.pdf | wePiYKvj-30.10. 2020|

[1] Avãyjøvn, Gm mvnj, Pv kÖwgK t `vmZ¡ hv‡`i wbZ¨m½x, ivBwRswewW.Kg, cÖKvkKvj-18 AvM÷,2020| †`Lyb- https://www.risingbd.com/campus/news/366900 | wePiYKvj-23.10.2020 wLª.|

[1] Pv kÖwgK‡`i b¨vh¨ gRywi †`Iqvi GLbB mgq, `¨ †WBwj ÷vi, evsjv ms¯‹iY, cÖKvkKvj-10.09.2020 wLª.| †`Lyb-https://www.thedailystar.net/bangla/মতামত/চা-শ্রমিকদের-ন্যায্য-মজুরি-দেওয়ার-এখনসময়-172429 wePiYKvj-26.10.2020 wLª.

[1] Vivek Voora, Steffany Bermúdez, Cristina Larrea, Global Market Report : Tea, International Institute for sustainable Development.Canada,2019. https://www.iisd.org/system/files/publications/ssi-global-market-report-tea.pdf, wePiYKvj-26.10.2020 wLª.|

[1]  †mb, ïwPeªZ, c~e© fvi‡Zi Avw`evmx Aw¯Í‡Z¡i msKU, †`ÕR cvewjwks, KjKvZv, cÖ_g cÖKvk- Rvbyqvwi,2003| c„.-20|

[1] ivq (gÛj), W. wkevbx, Avw`evmx fvlv I ms¯‹…wZ t cÖm½ b`xqv †Rjv,cy¯ÍK wecwb, KjKvZv, cÖ_g cÖKvk-A‡±vei,2002| c„.-40|

[1] Ave`yj Rwjj, gyn¤§`, evsjv‡`‡ki muvIZvj mgvR I ms¯‹…wZ, evsjv GKv‡Wgx, XvKv, cÖ_g ms¯‹KiY-b‡f¤^i,1991| c„.-2|

[1] ivq (gÛj), W. wkevbx, Avw`evmx fvlv I ms¯‹…wZ t cÖm½ b`xqv †Rjv,cy¯ÍK wecwb, KjKvZv, cÖ_g cÖKvk-A‡±vei,2002| c„.-78|



মনোদৈহিক ব্যাটাগিরি ও চা বাগানের জনজাতিসমূহের খণ্ডিত বয়ান

  ১ . আমরা ব্যাটাগিরি বুঝি না , আমরা বুঝি কেবলই দুঃখ - কষ্ট - অভাব - অনাহার - লাঞ্চনা - বঞ্চনা ... শরীর আর মনের উপর দিয়ে দগদগা ...